শবে বরাত কেন পালন করা হয়

শবে বরাত কেন পালন করা হয়, ইতিহাস ও হাদিস

শবে বরাত আসলেই অনেক মুসলমানের মনে শবে বরাত কেন পালন করা হয় সেই প্রশ্ন জাগে। শবে বরাত পালন করার পিছনে রয়েছে ইতিহাসও ইসলামিক হাদিস। অন্যদিকে শবে বরাত নিয়ে অনেক ধরনের মত রয়েছে যা নিয়ে তর্ক-বিতর্ক হয়ে থাকে। আমাদের সমাজে প্রচলিত আছে শবে বরাত অর্থ ভাগ্য রজনী। আজকের পোস্টে আমরা ইসলামিক হাদিসের আলোকে তুলে ধরবো শবে বরাত কেন পালন করা হয়। আরো বিস্তারিত আলোচনা করব শবে বরাত শব্দের অর্থ কি

শবে বরাত শব্দের অর্থ কি

বর্তমানে ইসলাম ধর্মের বিভিন্ন স্কলার এর মাঝে শবে বরাত নিয়ে বিভিন্ন দ্বিমত রয়েছে। কিন্তু আবার অনেকেই আছে যারা শবে বরাতকে অনেক গুরুত্বপূর্ণ মনে করে বিভিন্ন নফল ইবাদত পালন করে থাকে। কোরআন হাদিসের আলোকে সরাসরি কোথাও শবে বরাতের কথা উল্লেখ নেই তবে লাইলাতুল বরাত নিয়ে কিছু শব্দ পাওয়া গিয়েছে। শবে বরাত শব্দের বাংলা অর্থ করলে দাঁড়ায় সৌভাগ্যের রাত। হরতাল শব্দটি ফারসি শব্দ থেকে এসেছে। ফারসি ভাষায় শবে কথাটির অর্থ হল রাত বা রজনী। অন্যদিকে বরাত শব্দটি আরবি শব্দ থেকে এসেছে। কুরআন মাজীদে সূরাতে বারায়াত এর উল্লেখ পাওয়া যায় যাকে সূরা তাওবা নামেও জিকির করা হয়।

بَرَاءَةٌ مِنَ اللَّهِ وَرَسُولِهِ (التوبة: ১) অর্থ হল : আল্লা ও তার রাসূলের পক্ষ থেকে সম্পর্ক ছিন্ন করার ঘোষণা। সূরা তাওবা ০১) এখানে বারায়াত শব্দের অর্থ হল সম্পর্ক ছিন্ন করা। “বারায়াত” শব্দটি আল কুরআনে রয়েছে যেমন- أَكُفَّارُكُمْ خَيْرٌ مِنْ أُولَئِكُمْ أَمْ لَكُمْ بَرَاءَةٌ فِي الزُّبُرِ . (سورة القمر ৪৩) অর্থ হল : তোমাদের মধ্যেকার কাফিরবা কি তাদের চেয়েও শ্রেষ্ঠ ? না কি তোমাদের মুক্তির সনদ রয়েছে কিতাব সমূহে ?

সূরা কামার, ৩৪) আবার “বারায়াত” শব্দটিকে যদি ফার্সি শব্দ ধরা হয় তাহলে ফার্সি শব্দ ভাণ্ডারে বারায়াত শব্দটির অর্থ দাঁড়ায় সৌভাগ্য। সুতরাং আমরা যদি একসাথে “শবে বরাত” শব্দটির অর্থ খুঁজি এবং “বরাত” শব্দটিকে যদি ফার্সি শব্দ ধরে বাংলাতে মানে খোঁজা হয় তাহলে শবে বরাত শব্দ দুটির অনেক গুলো অর্থ দাঁড়াবে যেমন- “মুক্তির রজনী” বা “সম্পর্ক ছিন্ন করার রজনী”, অথবা “সৌভাগ্যের রাত। “ আবার আপনি যদি “শবে বরাত” শব্দটির আরবি অর্থে মানে খুঁজতে যান তাহলে শবে বরাত এর অর্থ দাঁড়ায় “লাইলাতুল বারায়াত।” কিন্তু যারা আরবি এবং ফার্সি ভাষার চর্চা করেন তারা ভালোভাবেই জানেন।

আরও জানুনঃ 

শবে বরাত কেন পালন করা হয়

সকল মুসলমান শবে বরাত কেন পালন করে সে সম্পর্কিত বিস্তারিত আলোচনা করা যাক। প্রতিবছর হিজরী ক্যালেন্ডার এর শাবান মাসের ১৪ তারিখ রাতে শবে বরাত পালন করা হয়। এই বছর শবে বরাত পালন করা হবে ২৫ ফেব্রুয়ারী রোজ রবিবার দিবাগত রাতে। অন্যদিকে বাংলাদেশ সরকার শবে বরাত হিসেবে সরকারি ছুটি ঘোষণা করেছে ২৬ ফেব্রুয়ারী রোজ সোমবার।

শবে বরাত কত তারিখে

সমাজে অনেক বিষয় প্রচলিত আছে যে মানুষ রাত্রে জেগে ইবাদত এর মাধ্যমে তাদের পূর্বপুরুষদের স্মরণ করে তাদের পাপ মার্জনা করার জন্য প্রার্থনা করে থাকে। অন্যদিকে নিজেদের সামনের সময় যাতে ভালো যায় তার জন্য মানুষ আল্লাহর কাছে দোয়া ও মাগফেরাত করতে থাকে।

অন্যদিকে অনেকেই বলে থাকে শবেবরাত হচ্ছে এমন একটি রাত্রে যে রাত্রে মাধ্যমে আগামী এক বছরের জন্য নিজের ভাগ্য নির্ধারণ করা হয়ে থাকে। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে কোরআন সুন্নাহ মোতাবেক এসব তথ্যের কোন ভিত্তি নেই। কারণ মানুষের ভাগ্যে কি হবে সেটা আল্লাহ জন্মের আগেই লিখে দিয়েছেন। তবে পবিত্র রমজান কে ভাগ্য নির্ধারণের মাস বলা যেতে পারে। তাই শবে বরাতে বিভিন্ন বিষয় সম্পর্কে বিস্তারিতভাবে ভালো আলেম থেকে জেনে তারপর আমল করবেন।

শবে বরাতের ইতিহাস

এখানে আমরা কিছু শবে বরাত সম্পর্কিত তথ্য ভাণ্ডার উল্লেখ করেছি। তবে যে কোনো তথ্যই হোক ভালো ভাবে যাচাই-বাছাই করে তারপর আমল করবেন। শবে বরাত উপলক্ষে রাসুলে আকরাম (সা:) হাদিস অনুযায়ী দুটি জিনিস করার জন্যে বলা হয়েছে – ০১) রাত জেগে আল্লার কাছে ইবাদত করা। যেমন- নফল নামাজ পড়া। কুরান তিলাওয়াত করা, তাসবিহ জপ করা, দোয়া-দুরুদ, তৌবা-ইস্তেগর ইত্যাদি। ০২) রোজা রাখা, হজরত মহম্মদ (সা:) গোটা শাবান মাস রোজা রাখতেন, তাই বান্দারা যদি পুরো শাবান মাস রোজা রাখতে পারলে অতি উত্তম।

শবে বরাতের কি হয়েছিল ? এই ধরণের প্রশ্ন অনেকের মনে ঘোর পাক খায়। শবে বরাতের রাত্রে ইবাদত করার পিছনে ফজিলত হাদিস অনুযায়ী শবে বরাতের রাতটির তাৎপর্য হল-

আলা ইবনুল হারিস (রহঃ) তে বর্ণনায় দেখতে পাওয়া যায়- হজরত আয়েশা (রাঃ) সেখানে বলেছেন, একদিন গভীর রাত্রে রাসূলুল্লাহ (সাঃ) নামাজ পড়ছিলেন। নামাজ পড়ার সময় রাসূলাল্লাহ (সাঃ) দীর্ঘ্যক্ষন দাঁড়িয়ে থেকে সেজদা করেন। অনেক্ষন এভাবে দাঁড়িয়ে থেকে সেজদা করতে দেখে, হজরত আয়েশা (রাঃ) এর ধারণা হয়, রাসূলাল্লাহ (সাঃ) হয়তো নামাজ পড়তে গিয়ে ইন্তেকাল করেছেন।

হজরত আয়েশা (রাঃ) তখন তার সন্দেহ দূর করার জন্যে রাসূল্লাহ (সাঃ) বৃদ্ধাঙ্গুলীটিকে ধরে নাড়া দেয়। তাতে রাসূলাল্লাহ (সাঃ) আঙুল নাড়িয়ে সারা দেয়। এরপর রাসূলাল্লাহ (সাঃ) সেজদা থেকে উঠে নামাজ শেষ করে, হজরত আয়েশা (রাঃ) কে বললেন “হে আয়েশা ! তোমার কি ধারণা, আল্লাহর রাসূল তোমার হক নষ্ট করবেন ? হজরত আয়েশা (রাঃ) তখন উত্তরে বলেন- না, ইয়া রাসূল্লাহ। “আপনার দীর্ঘ্যক্ষন সেজদা করা দেখে

আমি আশঙ্কিত হয়ে পড়েছিলাম, আমার মনে হয়েছিল আপনি হয়তো ইন্তেকাল করেছেন ? তাই আমি আমার সন্দেহ মেটানোর জন্যে আপনার আঙুল নেড়ে, আপনাকে পরীক্ষা করে দেখছিলাম আপনি জীবিত আছেন কিনা ?” নবীজি তখন আয়েশাকে জিজ্ঞেস করেন তুমি কি জান আজকের রাত টি কি রাত ? আয়েশা তখন নবীজিকে বলেন, আল্লাহ ও তার রাসূলই আমার অপেক্ষা ভাল জানবেন আজেকের রাত টির তাৎপর্য কি ?

তখন রাসূলাল্লাহ (সাঃ) বললেন আজকের রাত টি হল অর্ধ শাবানের রাত। মহান আল্লাহ তালাহ অর্ধ-শাবানের রাত্রে তার বান্দার সকল প্রার্থনা মনোযোগ সহকারে শোনেন এবং যারা ক্ষমা প্রার্থী তাদের পাপ ক্ষমা করে দেন। আর যারা অনুগ্রহ প্রার্থী তাদের অনুগ্রহ করেন, তাদের বরকত প্রদান করেন । আর যারা বিদ্বেষ প্রদানকারী তাদের ক্ষমা না করে তাদের নিজের অবস্থাতেই ছেড়ে দেন। (বাইহাকী)

ইসলাম ধর্মে শবে বরাত কোনো আনন্দ উৎসব নয়। শবে বরাতের রাত হল ইবাদত করার রাত। তাই শবে বরাতের দিন রাত্রি বেলা আতস বাজি ফাটানো, কবর স্থান সহ বাড়িতে,মসজিদে আলোক সজ্জায় সজ্জিত করা, মাংস,হালুয়া-রুটি সহ বিভিন্ন খাবার দিয়ে বন্ধু বান্ধবদের সাথে ফুর্তি করার জন্যে পার্টির আয়োজন করা ইসলাম ধর্মে কখনই জায়েজ নয়। শাবান মাস সহ শবে বরাতের রাত হল আল্লার কাছে ইবাদত করার একটি উপযুক্ত সময় এই মাত্র।

শবে বরাত সম্পর্কিত হাদিস

এখানে আমরা কিছু শাবান মাস বা শবে বরাত সম্পর্কিত হাদিস উল্লেখ করেছি। এগুলো আমরা বিভিন্ন সোর্স থেকে সংগ্রহ করে উল্লেখ করেছি। তাই কোন কিছু মানার আগে অবশ্যই ভালোভাবে যাচাই করে নিবেন।

শাবান মাসের ১৪ তম দিবাগত রাতকে হাদিসে শবে বরাত বলা হয়। “শবে বরাত” কুরানে বর্ণিত যে শব্দটিকে অনুকরণ করে ব্যবহার করা হয় সেই শব্দটি হল “লাইলাতুল মুবারক।”

إِنَّآ أَنزَلْنَٰهُ فِى” لَيْلَةٍ مُّبَٰرَكَةٍۚ” إِنَّا كُنَّا مُنذِرِينَ এর অর্থ হল আল্লাহ প্রদত্ত একটি বরকতময় রাত। হাদিসে শবে বরাতকে ‘লাইলাতুন নিসফি মিন শাবান’ মাসের মধ্যে দিনের রাত হিসাবে উল্লেখ করা হয়েছে।

শাবান মাসের মধ্য দিনটি হল শাবান মাসের ১৫ তারিখ। সিহা সিত্তার হাদিসে ইবনে মাজাহ ও বায়হাকী শরীফের উদ্ধৃতিতে- পবিত্র শবে বরাত নিয়ে বলা হয়েছে নিসফি মিন শাবান মানে শাবান মাসের ১৫ তারিখ।

শবে বরাতের উল্লেখ করে বেলায়েতের সম্রাট মাওলানা হজরত আলী ইবনে আবু তালেব (আ:) বর্ণনা করে বলেছেন- রাসূল্লাহ (সাঃ) তাতে বলেছেন

“যখন শাবান মাসের মধ্যেকার (শাবান মাসের ১৫ তারিখ) রাতে তোমরা রাত জেগে ইবাদত করবে,তসবি জপ করবে আর দিনের বেলা সিয়াম পালন করবে।

কেননা মহান আল্লা তালাহ সূর্য অস্ত হওয়ার পর দুনিয়ায় আসমানে নেমে এসে আসেন এবং আল্লার কোনো বান্দা যদি কেউ আল্লার কাছে হিদায়ত করে ক্ষমা চায় তাহলে আল্লা তাকে ক্ষমা প্রার্থনা করেন।

শবে বরাত পালন করার নিয়ম

শবে বরাত উপলক্ষে আপনি নফল ইবাদত করতে পারেন। তবে সমাজে যে বিষয়গুলো নিয়ে বাড়াবাড়ি করা হয় সেসব থেকে দূরে থাকবেন। নফল নামাজ আপনার যত ইচ্ছা আপনি পড়তে পারেন। কিন্তু অবশ্যই খেয়াল রাখবেন সারারাত নফল নামাজ পড়ে ফজরের ফরয নামায যেন কাজা আনা হয়। শবে বরাতের নামাজের সূরা ফাতিহার সাথে যে কোন সূরা মিলিয়ে আপনি পড়তে পারেন। কারণ শবে বরাতের নামাজ একটি নফল ইবাদত। তাই সাধারণভাবে নফল ইবাদতের নামাজ যেভাবে করেন সেভাবেই শবে বরাতের নামাজ পড়তে পারেন।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top